এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য একককে বলা হয় শব্দ। অর্থাৎ ধ্বনির অর্থপূর্ণ মিলন ঘটলে তাকে শব্দ বলে। যেমন: ক্+অ+ল্+অ+ম্ ধ্বনি। এ ধ্বনি পাঁচটির মিলিত রূপ হলো 'কলম'। 'কলম' এমন একটি বস্তুকে বোঝাচ্ছে, যা দিয়ে লেখা যায়। 'কলম'- 'ক', 'ল', 'ম' ধ্বনিসমষ্টির মিলিত রূপ, যা অর্থপূর্ণ। সুতরাং 'কলম' একটি শব্দ।
গঠনগত দিক থেকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত: ক. মৌলিক শব্দ ও খ. সাধিত শব্দ।
ক. মৌলিক শব্দ: যেসব শব্দ বিশ্লেষণ করা যায় না বা ভেঙে আলাদা করা যায় না, সেগুলোকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন:
আম, বই, কলম ইত্যাদি।
মৌলিক শব্দ গঠনের প্রথম উপায় বর্ণের সঙ্গে বর্ণ যোগ। যেমন:
আ + ম = আম
ব + ই = বই
ক + ল + ম = কলম ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে 'কার' এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে 'ফলা' বলা হয়। সরল বর্ণের সঙ্গে 'কার' বা 'ফলা' যোগ করে শব্দ গঠন করা যায়। নিচে 'কার' ও 'ফলা' যোগে শব্দ গঠনের উদাহরণ প্রদত্ত হলো:
'কার' যোগ করে
ক্ + অ = ক, ল্ + আ = লা দুটোর মিলনে ক + লা= কলা।
উপর্যুক্ত উদাহরণে ক্-এর সঙ্গে 'অ' যুক্ত হয়ে প্রথমে 'ক' হয়েছে এবং ল্-এর সঙ্গে 'আ' যুক্ত হয়ে 'লা' হয়েছে। 'ক' ও 'লা' মিলিত হয়ে 'কলা' শব্দটি গঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, অ-এর কোনো সংক্ষিপ্ত রূপ নেই। অ-ব্যঞ্জনের সঙ্গে অন্তর্লীন হয়ে যায়। যেমন: ক্+ অ = ক, খ + অ = খ।
'ফলা' যোগ করে
য-ফলা (্য) : ক্ + য = ক্য। উদাহরণ: বাক্য, ঐক্য, আধিক্য।
র-ফলা (্র) : ক্র = ক্র। উদাহরণ: চক্র, বক্র।
ম-ফলা (ত্ম) : ত্ + ম =ত্ম । উদাহরণ: আত্ম।
দ্+ম = দ্ম। উদাহরণ: পদ্ম।
হ্+ম =হ্ম। উদাহরণ: ব্রাহ্মণ।
ব-ফলা () : স্+ব = স্ব।
উদাহরণ: নিঃস্ব।
শ্+ব =শ্ব।
উদাহরণ: অশ্ব, বিশ্ব।
র-এর আরেকটি সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রেফ [র্র]। রেফ বর্ণের শীর্ষে যুক্ত হয়। যেমন: র্ক। উদাহরণ: অর্ক, তর্ক, সতর্ক।
খ. সাধিত শব্দ: যেসব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে আলাদা অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায়, সেগুলোকে সাধিত শব্দ বলে।
সাধারণত কোনো মৌলিক বা ভিত্তি শব্দের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাকরণিক উপাদান যুক্ত হয়ে সাধিত শব্দ গঠিত হয়। শব্দের অর্থ-বৈচিত্র্যের জন্য নানাভাবে শব্দের রূপ-রূপান্তর সাধন করা হয়। বিভিন্ন অর্থে ব্যবহারোপযোগী করে কোনো শব্দ বা শব্দাংশের সঙ্গে অন্য শব্দ বা শব্দাংশের মিলনে নতুন নতুন শব্দ গঠিত হয়ে থাকে।
শব্দগঠন: শব্দগঠন বলতে সাধারণভাবে আমরা শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বুঝে থাকি। নতুন শব্দ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াকে শব্দগঠন বলে। যে কোনো ভাষার শব্দগঠন প্রক্রিয়া দুইটি।
১। প্রত্যয়ের সাহায্যে শব্দগঠন ও
২। সমাসের সাহায্যে শব্দগঠন
উপসর্গ শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়, উপাদান মাত্র। কারণ উপসর্গযুক্ত সকল শব্দই সমাস-সাধিত শব্দ; হয় অব্যয়ীভাব সমাস, না হয় প্রাদি সমাস। কাজেই উপসর্গযোগে শব্দগঠন প্রকারান্তরে শব্দগঠনের প্রক্রিয়া আলোচনা করা অবান্তর।
সন্ধি শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়। কেননা সন্ধিবদ্ধ শব্দ মাত্রই হয় প্রত্যয়-সাধিত শব্দ, নয় সমাস-সাধিত শব্দ। প্রত্যয় ও সমাসের সাহায্যে শব্দ গঠনকালে সন্ধি হলো পাশাপাশি অবস্থিত ধ্বনি-সংযোগের নিয়ম। এ প্রসঙ্গে প্রত্যয়-সন্ধির সূত্রাবলি স্মরণযোগ্য।
বিভক্তির সাহায্যে শব্দগঠিত হয় না। বিভক্তিযোগে শব্দ ও ধাতু পদবাচ্য হয়। তাই বিভক্তিযোগে শব্দগঠন আলোচনা করা নিরর্থক।
এখন শব্দগঠন প্রক্রিয়া দুইটি আলোচনা করা হলো:
১. প্রত্যয়যোগে শব্দ গঠন: শব্দ বা ধাতুর পরে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন:
মিঠা + আই = মিঠাই কুসুম + ইত = কুসুমিত
√চল্ + অন্ত = চলন্ত √কৃ + তব্য = কর্তব্য
বিমান + ইক = বৈমানিক মনু + অ = মানব
২. সমাসের সাহায্যে শব্দ গঠন: পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই বা ততোধিক পদের একপদে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন:
মাতা ও পিতা = মাতা-পিতা সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন
দিন দিন = প্রতিদিন বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু
বাংলা ভাষায় শব্দ গঠনের নিয়ম জানা থাকলে কোন শব্দ ব্যাকরণগত কোন শ্রেণিতে পড়ে, সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় এবং বহুল প্রচলিত শব্দের বদলে নতুন নতুন শব্দ গঠন করে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা যায়। সর্বোপরি ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলতে, পড়তে, লিখতে এবং ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে শব্দের গঠন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
বাংলা ভাষায় এমন কতকগুলো অব্যয়সূচক শব্দাংশ আছে, যেগুলো কখনোই স্বাধীন পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না। বস্তুত, যেসব অব্যয়-শব্দ ধাতু বা নাম শব্দের পূর্বে বসে শব্দগুলোর অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ বা অন্য কোনো পরিবর্তন সাধন করে, ঐ সব অব্যয় শব্দই উপসর্গ নামে পরিচিত।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যেমন 'ভাত' একটি শব্দ। এর পূর্বে 'প্র' অব্যয়টি যুক্ত হলে হয় 'প্রভাত' যার অর্থ 'প্রত্যুষ' বা 'প্রাতঃকাল'। 'নাম' শব্দের পূর্বে 'প্র' যোগ করলে হয় 'প্রণাম' যার অর্থ 'অভিবাদন' বা 'নমস্কার'। 'গতি' শব্দের পূর্বে 'প্র' যোগ করলে হয় 'প্রগতি' যার অর্থ 'সামাজিক অগ্রগতি' বা 'সমৃদ্ধি'। এখানে একই উপসর্গ একাধিক অর্থদ্যোতনার সৃষ্টি করেছে। আবার উপসর্গভেদে শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। যেমন: 'নাম' শব্দের পূর্বে 'সু' উপসর্গ যুক্ত হলে হয় 'সুনাম'। 'বদ' উপসর্গ যুক্ত হলে হয় 'বদনাম'। লক্ষণীয় যে 'সুনাম' ও 'বদনাম'-এ শব্দ দুটোর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। এভাবে বিভিন্ন শব্দ বা ধাতুর পূর্বে বিভিন্ন অব্যয়সূচক শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে।
সংজ্ঞা: যেসব অব্যয়সূচক শব্দাংশ ধাতু বা শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠনপূর্বক অর্থের সম্প্রসারণ, সংকোচন বা পরিবর্তন সাধন করে, সেগুলোকে উপসর্গ বলে।
শব্দ বা ধাতুর আদিতে যা যোগ হয় তাকে বলে উপসর্গ। - ডক্টর রামেশ্বর শ'
নিচে 'নাম' মূল শব্দের সঙ্গে বিভিন্ন উপসর্গযোগে শব্দ গঠনের একটি লেখচিত্র প্রদত্ত হলো:
উপসর্গের কার্যাবলি : উপসর্গ একধরনের উপসৃষ্টি। উপসর্গযোগে শব্দের যে ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তা প্রধানত নিম্নরূপ:
১. নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি হয়
২. শব্দের অর্থের পূর্ণতা সাধিত হয়
৩. শব্দের অর্থের সম্প্রসারণ ঘটে
৪. শব্দের অর্থের সংকোচন ঘটে এবং
৫. শব্দের অর্থের পরিবর্তন সাধিত হয়।
উপসর্গের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই কিন্তু এরা অর্থের দ্যোতক। উপসর্গ অন্য শব্দ বা ধাতুর পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি বা শব্দের অর্থের সম্প্রসারণ, সংকোচন বা পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যেমন:
হা + ভাত = হাভাত (নতুন শব্দ)
পরি + পূর্ণ = পরিপূর্ণ (অর্থের সম্প্রসারণ)
অ + ভাব = অভাব (অর্থের সংকোচন)
উপ + কথা = উপকথা (অর্থের পরিবর্তন)
কিন্তু 'হা', 'পরি', 'অ', 'উপ' -এগুলোর আলাদা কোনো অর্থ নেই। শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে যুক্ত না হলে উপসর্গ কোনো অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থাৎ উপসর্গ স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হয়ে অর্থদ্যোতনা সৃষ্টি করতে অক্ষম। কিন্তু যখনই এরা ধাতু বা শব্দের পূর্বে বসে, তখনই এদের অর্থদ্যোতকতা শক্তি সৃষ্টি হয়। যেমন: 'হাব' শব্দটিব পর্বে বিভিন উপসর্গযোগে অনেকগুলো অর্থদ্যোতক শব্দ গঠিত হতে পাবে:
উপরের লেখচিত্রে আ, অনা, প্র, পরি, উপ, বি উপসর্গগুলোর স্বাধীন কোনো অর্থ নেই। কিন্তু এ উপসর্গগুলো 'হার' শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে অর্থবোধক একাধিক শব্দ তৈরি করেছে। সুতরাং বলা যায় উপসর্গের স্বাধীন কোনো অর্থ নেই কিন্তু অর্থদ্যোতকতা আছে।
উপসর্গের প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষায় উপসর্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উপসর্গ শব্দ বা ধাতুর পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন করে এবং অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ বা পরিবর্তন ঘটায়। উপসর্গ নতুন শব্দ সৃষ্টি করে ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বস্তুত শব্দ গঠন ও অর্থের দিক থেকে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করাই উপসর্গের কাজ। উপসর্গ অর্থহীন হলেও এদের সার্থক প্রয়োগে ভাষার অভ্যন্তরীণ শক্তি ও ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পায়।
উপসর্গযোগে শব্দ গঠন:
উপসর্গ | উদাহরণ |
অ | অকাজ, অচিন, অজানা, অখুশি, অচেনা, অমিল, অকাল, অবেলা, অনড়। |
অঘা | অঘাচণ্ডী, অঘারাম। |
অজ | অজপাড়াগাঁ, অজমূর্খ, অজপুকুর। |
অনা | অনাবৃষ্টি, অনাদর, অনাদায়, অনাসৃষ্টি, অনাচার, অনামুখো, অনাদর, অনাদায়। |
আ | আকাঁড়া, আধোয়া, আলুনি, আমাপা, আঘাটা, আকাট, আকাল, আকাঠা। |
আড় | আড়চোখে, আড়নয়নে, আড়পাগলা, আড়ক্ষ্যাপ্যা, আড়কোলা, আড়গড়া। |
আন | আনকোরা, আনচান, আনমনা। |
আব | আবছায়া, আবডাল। |
ইতি | ইতিকর্তব্য, ইতিপূর্বে, ইতিকথা, ইতিহাস। |
উন (উনা) | ঊনপাঁজুরে, উনিশ, উনবর্ষা। |
কদ্ | কদবেল, কদর্য, কদাকার। |
কু | কুঅভ্যাস, কুকথা, কুসঙ্গ, কুনজর, কুকাম, কুযশ। |
নি | নিখুঁত, নিখোঁজ, নিখরচা, নিভাঁজ, নিরেট, নিলাজ, নিটোল, নিরেট। |
পাতি | পাতিকাক, পাতিহাঁস, পাতিলেবু, পাতকুয়া। |
বি | বিভুঁই, বিফল, বিপথ, বিদেশ, বিজোড়। |
ভর | ভরপুর, ভরপেট, ভরদুপুর, ভরসন্ধ্যা, ভরদিন, ভরসাঁঝ। |
রাম | রামছাগল, রামদা। |
স | সঠিক, সরব, সলাজ, সটান, সজোর, সখেদ, সজ্ঞান। |
সা | সাজোয়ান, সাজিরা। |
সু | সুখবর, সুদিন, সুনজর, সুনাম, সুডৌল। |
হা | হাপিত্যেশ, হাভাতে, হাঘরে, হাহুতাশ। |
প্র | প্রকাশ, প্রভাত, প্রচলন, প্রগতি, প্রহার, প্রতাপ, প্রভাব, প্রচেষ্টা, প্রবেশ, প্রচার, প্রশাখা, প্রদান। |
পরা | পরামর্শ, পরাধীন, পরাক্রম, পরাকাষ্ঠা, পরায়ণ, পরাজয়, পরাভব। |
অপ | অপমান, অপকার, অপচয়, অপবাদ, অপকর্ম, অপব্যয়, অপযশ, অপব্যাখ্যা, অপসারণ, অপমৃত্যু। |
সম্ | সমাদর, সমাগত, সম্মুখ, সম্পূর্ণ, সংবাদ, সংযম, সম্মান, সমধিক। |
নি | নিথর, নিবাস, নিগম, নিচয়, নিবৃত্তি, নিবারণ, নিদাঘ, নিগূঢ়, নিষ্কলুষ, নিষ্কাম। |
অনু | অনুতাপ, অনুগ্রহ, অনুগামী, অনুজ, অনুচর, অনুবাদ, অনুরূপ, অনুকরণ, অনুসরণ, অনুক্ষণ। |
অব | অবকাশ, অবসর, অবজ্ঞা, অবমাননা, অবগত, অবগাহন, অবরোধ, অবতরণ, অবরোহণ। |
নির্ | নিরক্ষর, নির্জীব, নিরহংকার, নির্ধারণ, নির্দেশ, নির্ণয়, নির্ভয়, নির্গত, নির্বাসন, নিরীক্ষণ, নিরঙ্কুশ। |
দুর্ | দুর্ভাগ্য, দুর্দশা, দুর্নাম, দুর্লভ, দুর্গম, দুর্জয়, দুর্ঘটনা, দুর্দিন, দুর্নীতি, দুর্বল, দুর্যোগ। |
বি | বিজয়, বিপক্ষ, বিজ্ঞান, বিশুদ্ধ, বিশুষ্ক, বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিফল, বিচরণ, বিক্ষেপ, বিকার, বিপর্যয়। |
অধি | অধিকার, অধিপতি, অধিবাসী, অধিকর্তা, অধিবেশন, অধিবর্ষ, অধিনায়ক, অধিকর্তা, অধিষ্ঠান। |
সু | সুকণ্ঠ, সুকৃতি, সুনীল, সুগম, সুলভ, সুকঠিন, সুধীর, সুচতুর, সুরম্য, সুনিপুণ, সুদূর, সুচরিত্র। |
উৎ | উৎসব, উৎক্ষিপ্ত, উদগ্রীব, উত্তোলন, উত্তপ্ত, উৎফুল্ল, উৎসুক, উৎপাদন, উচ্চারণ, উদ্দেশ্য। |
পরি | পরিপক্ক, পরিপূর্ণ, পরিমাণ, পরিশেষ, পরিসীমা, পরিশ্রম, পরিতাপ, পরিচালক, পরিদর্শন। |
প্রতি | প্রতিদান, প্রতিকার, প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেশী, প্রতীক্ষা, প্রতিমূর্তি, প্রতিধ্বনি, প্রতিদিন। |
অভি | অভিব্যক্তি, অভিজ্ঞ, অভিভূত, অভিধান, অভিনয়, অভিযান, অভিসার, অভিমুখ, অভিবাদন। |
অতি | অতিকায়, অত্যাচার (অতি + আচার), অতিশয়, অতিক্রম, অতিরিক্ত, অত্যন্ত (অতি + অন্ত)। |
অপি | অপিনিহিত, অপিনিহিতি, অপিধান। |
উপ | উপকার, উপকূল, উপকণ্ঠ, উপদ্বীপ, উপবন, উপগ্রহ, উপসাগর, উপনেতা, উপনয়ন (পৈতা)। |
আ | আকণ্ঠ, আমরণ, আসমুদ্র, আরক্ত, আভাস, আদান, আগমন, আগ্রহ, আহার, আরক্ত। |
বাক্যে উপসর্গযুক্ত শব্দের প্রয়োগ
অ : লোকটি আমার অচেনা।
অঘা : অঘারাম বলেই সে এমন কাণ্ড করে বসেছে।
অজ : অজপাড়াগাঁয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে।
অনা : অনাবৃষ্টিতে এ বছর ফসলের বিস্তর ক্ষতি হয়েছে।
আ : আধোয়া প্লেটে খাবার খেতে নেই।
আড় : মিতা রিতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে।
আন : সন্তানের জন্য মায়ের মন সব সময়ই আনচান করে।
আব : আড়ালে আবডালে কারো সমালোচনা করতে নেই।
ইতি : ইতিহাস থেকে সকলেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত।
উন/উনা : 'উনাভাতে দুনা বল।'
কদ্ : কদবেলে প্রচুর ভিটামিন আছে।
কু : কুসঙ্গ কুফল বয়ে আনে।
নি : মেয়েটির সূচিকর্ম খুবই নিখুঁত।
পাতি : ঝিলের জলে পাতিহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে।
বি : সাধনা কখনো বিফলে যায় না।
ভর : এখন ভরদুপুর, একটু পরে বের হও।
রাম : রামছাগলের বাচ্চাটা তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে।
স : সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দাও।
সা : লড়াইয়ে জিততে হলে সাজোয়ান লোকই প্রয়োজন।
সু : সৎকর্ম সুনাম বয়ে আনে।
হা : হাভাতে ছেলেটার জন্য মায়ের কত হাপিত্যেশ।
বাংলা ভাষায় বহু সংস্কৃত শব্দ অবিকৃতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সঙ্গে তৎসম উপসর্গও সংস্কৃত শব্দের পূর্বে বসে নতুন শব্দ তৈরি করে অর্থের সংকোচন বা সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। উল্লেখ্য, খাঁটি বাংলা উপসর্গ যেমন খাঁটি
বাক্যে তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গযুক্ত শব্দের প্রয়োগ
প্র : 'প্রভাতে উঠিল রবি লোহিত বরণ।'
পরা 'পরাজয়ে ডরে না বীর।'
অপ : অপব্যয় দারিদ্র্য ডেকে আনে।
সম্ : অতিথি সমাদরে কার্পণ্য অনুচিত।
নি : এখনই বৃষ্টি নামবে, তাকে যেতে নিবারণ কর।
অব : সমাজের কল্যাণে প্রত্যেকেরই অবদান রাখা উচিত।
অনু : অনুগ্রহ করে একটু বাইরে আসুন।
নির : গুরুজনের নির্দেশ অমান্য করো না।
দুর : দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
বি : লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি।
সু : সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ।
উৎ : চাষিদের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব।
অধি : নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে।
পরি : হিংসার পরিণাম কখনোই ভালো হয় না।
প্রতি : অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
উপ : উপকারীর উপকার স্বীকার করা উচিত।
অভি : ফরহাদ সাহেব একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক।
অপি : অপিনিহিতি ধ্বনি পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ম।
অতি : বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়াই স্বাভাবিক।
আ : আকণ্ঠ ভোজনে স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)
১। 'তর' ও 'তম' প্রত্যয় দুটি যুক্ত হয় কোন রীতিতে?
ক. বাংলা রীতি
খ. সংস্কৃত রীতি
গ. দেশী
ঘ. বিদেশী
২। উপসর্গের কাজ-
i. নতুন শব্দ গঠন করা
ii. অর্থের পরিবর্তন করা
iii. অর্থের সম্প্রসারণ করা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii, ও iii
১। প্র, কার, প্রতি, অব, আ, অভি, অনু, ফি, অ, অনা, বর, রাম, হা, কম উপসর্গগুলো নিচের ছকে সঠিক শ্রেণিতে বিন্যস্ত কর।
বাংলা উপসর্গ | তৎসম (সংস্কৃত) উপসর্গ | বিদেশি উপসর্গ |
|
|
|
কৃৎ ও তদ্ধিত দুই ধরনের প্রত্যয়ই শব্দ গঠনে সহায়ক। 'যা পরে যুক্ত হয় তা-ই প্রত্যয়।' সুতরাং যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতু বা প্রাতিপদিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তা-ই প্রত্যয়।
ভাষার সমৃদ্ধি শব্দের ওপর নির্ভরশীল। যে ভাষায় যত বেশি শব্দ আছে, সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষায় শব্দ গঠনের একটি অন্যতম রীতি হচ্ছে প্রত্যয়। কিন্তু প্রত্যয়ের নিজের কোনো স্বাধীন অর্থ নেই।
সংজ্ঞা: যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতু বা শব্দের পরে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থবোধক শব্দ গঠন করে, তাকে প্রত্যয় বলে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, ধাতু বা শব্দের উত্তর ভিন্ন ভিন্ন অর্থে যে বর্ণ বা বর্ণসমূহ যুক্ত হইয়া শব্দ প্রস্তুত হয়, তাহাদিগকে প্রত্যয় বলে।
যেমন:
হাত + আ = হাতা; মনু + অ = মানব; চল্ + অন্ত চলন্ত; কৃ + অক = কারক।
এখানে, 'আ', 'অ', 'অন্ত', এবং 'অক'-এগুলো প্রত্যয়। 'হাত', 'মনু' নাম-প্রকৃতি এবং চল্', 'কৃ' ক্রিয়া- প্রকৃতি।
প্রত্যয়ের শ্রেণিবিভাগ: প্রত্যয় প্রধানত দুই প্রকার। যথা: ১. কৃৎ প্রত্যয় ও ২. তদ্ধিত প্রত্যয়।
কৃৎ প্রত্যয়: ধাতুর পরে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে কৃৎ প্রত্যয় বলে। যেমন:
√ধর্ + আ = ধরা ডুব্ + উরী = ডুবুরী দৃশ্ + য = দৃশ্য ইত্যাদি।
তদ্ধিত প্রত্যয়: শব্দের পরে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে তদ্ধিত প্রত্যয় বলে। যেমন:
বাঘ + আ = বাঘা সোনা আলি সোনালি সপ্তাহ ইক সাপ্তাহিক ইত্যাদি।
প্রত্যয়ের মাধ্যমে শব্দগঠনের ক্ষেত্রে 'প্রকৃতি' ও 'প্রাতিপদিক' এ দুটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
প্রকৃতি: শব্দ বা ধাতুর মূলই হচ্ছে প্রকৃতি। অর্থাৎ 'মৌলিক শব্দের যে অংশকে আর কোনোভাবেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, তাকে বলা হয় প্রকৃতি।' অথবা, ভাষায় যার বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, এমন মৌলিক শব্দকে প্রকৃতি বলে। শব্দ কিংবা পদ থেকে প্রত্যয় ও বিভক্তি অপসারণ করলে প্রকৃতি অংশ পাওয়া যায়।
প্রকৃতি দুই প্রকার। যথা:
(ক) ক্রিয়া-প্রকৃতি বা ধাতু,
(খ) নাম-প্রকৃতি বা সংজ্ঞা-প্রকৃতি।
(ক) ক্রিয়া-প্রকৃতি: প্রত্যয়-নিষ্পন্ন শব্দের বিশ্লেষণে মৌলিক ভাব-দ্যোতক যে অংশ পাওয়া যায়, তা যদি অবস্থান, গতি বা অন্য কোনো প্রকারের ক্রিয়া বোঝায়, তাকে ক্রিয়া-প্রকৃতি বলে। যেমন: চল্, √পড়, খরাখ, দৃশ, ঠক্ প্রভৃতি ক্রিয়া-প্রকৃতি। [চলন্ত = চল্ (ক্রিয়া-প্রকৃতি) + অন্ত (প্রত্যয়)]
(খ) নাম-প্রকৃতি: প্রত্যয়-নিষ্পন্ন শব্দের বিশ্লেষণে মৌলিক ভাব-দ্যোতক যে অংশ পাওয়া যায়, তা যদি কোনো দ্রব্য, জাতি, গুণ বা কোনো পদার্থকে বোঝায়, তাকে নাম-প্রকৃতি বলে। যেমন: মা, চাঁদ, গাছ, প্রভৃতি নাম-প্রকৃতি।
হাতল = হাত (নাম-প্রকৃতি) + অল (প্রত্যয়)।
প্রাতিপদিক: বিভক্তিহীন নাম শব্দকে প্রাতিপদিক বলে। যেমন: হাত, বই, কলম, মাছ ইত্যাদি।
প্রত্যয় সম্পর্কে জ্ঞাতব্য
১. ক্রিয়াবাচক শব্দমূলের ক্ষেত্রে ধাতু চিহ্ন (√) ব্যবহৃত হয়। যেমন: √চল্ + অন্ত চলন্ত; √পঠ্ + অক = পাঠক।
২. 'ধাতু' ও 'প্রত্যয়' উভয়কে একসঙ্গে উচ্চারণ করার সময় ধাতুর অন্ত্যধ্বনি এবং প্রত্যয়ের আদিধ্বনি অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রভাবে সমতা প্রাপ্তহয়। যেমন √কাঁদ্ + না কান্না; √রাঁধ + না = রান্না। = উল্লিখিত উদাহরণে ধাতুর অন্ত্যধ্বনি 'দ' ও 'ধৃ' প্রত্যয়ের আদিধ্বনি 'ন'-এর সমতাপ্রাপ্ত হয়েছে।
কৃৎ এবং তদ্ধিত প্রত্যয়ের সংখ্যা অনেক। নিচে প্রয়োজনীয় কিছুসংখ্যক প্রত্যয়ের মাধ্যমে শব্দ গঠনের উদাহরণ প্রদত্ত হলো:
১. অ (অচ্)
√পট্ + অ = পাঠ।
√জি + অ = জয়।
২. অনীয় (অনীয়র্)
√কৃ + অনীয় = করণীয়।
√পা + অনীয় = পানীয়।
√স্মৃ + অনীয় = স্মরণীয়।
√দৃশ্ + অনীয় = দর্শনীয়।
৩. তি (ক্তি)
√কৃ+ তি = কৃতি।
√কৃত্ + তি = কীর্তি।
√কৃষ+ তি = কৃষ্টি।
√দৃশ্ + তি = দৃষ্টি।
৪. অ
√কাঁদ্ + অ = কাঁদ।
√ধর্+অ= ধর।
√চল্ + অ = চল।
√পড়্ + অ = পড়।
৫. অন > ওন
√নাচ্ + অন = নাচন।
√কাঁদ্ + অন = কাঁদন।
৬. আইত
√ডাক্ + আইত = ডাকাইত > ডাকাত।
√সের্ + আইত = সেবাইত > সেবায়েত।
৭. আনি
√জ্বাল্ + আনি = জ্বালানি।
√ঝাঁক্ + আনি = ঝাঁকানি।
√নিডু + আনি = নিড়ানি।
৮. উক, উকা
√মিশ্ + উক = মিশুক।
√খা + উকা = খাউকা > খেকো।
৯. তি
√উঠ+ তি = উঠতি।
√ঘাট্ + তি = ঘাটতি।
√কাট্ + তি = কাটতি।
১০. অ (ষ্ণ, অণু)
মনু + অ = মানব।
দনু + অ = দানব।
মধু+অ= মাধব।
১১. আয়ন (ষ্ণায়ন, ফক্)
নর + আয়ন = নারায়ণ।
দ্বীপ + আয়ন = দ্বৈপায়ন।
রাম + আয়ন = রামায়ণ
১২. ইক (জ্ঞিক, ঠক)
অক্ষর + ইক = আক্ষরিক।
ইতিহাস + ইক = ঐতিহাসিক।
বর্ষ + ইক = বার্ষিক।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)
১। প্রাতিপদিকের সঠিক উদাহরণ কোনটি?
ক. হাতল
খ. হাত
গ. হাতা
ঘ. হাভাত
২। নিচের কোনটি বিদেশী তদ্বিত প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দ?
ক. বাবু + আনা = বাবু আনা
খ. পঠ + অ = পাঠ
গ. ধন + ঈ = ধনী
ঘ. হাত+অল = হাতল
১. একটি পোস্টার পেপারে নিচের সংজ্ঞাগুলো সাইন পেন দ্বারা লিপিবদ্ধ কর।
প্রত্যয় : কৃৎ প্রত্যয় : তদ্ধিত প্রত্যয়: প্রকৃতি : ক্রিয়া-প্রকৃতি: নাম-প্রকৃতি : |
২. প্রদত্ত শব্দগুলোর প্রত্যয়ের নামসহ প্রকৃতি ও প্রত্যয় নির্ণয় করে নির্দেশমতো নিচের ছকে সাজাও:
প্রদত্ত শব্দ | প্রকৃতি + প্রত্যয় | প্রত্যয়ের নাম |
দর্শনীয় | ||
দেশীয় | ||
গন্তব্য | ||
উচ্চতর | ||
নীলিমা |
common.read_more